Friday, 20 March 2020

১০৬ ‌‌বছরের পুরানো পাইস হোটেল (Bengali script)

লেক মার্কেটের গা ঘেঁষে রাসবিহারী এভিনিউর মোড়ের দিকে চলতে চলতে একটা সরু গলির ভিতরে, একটা প্রায় এই বুঝি ভেঙ্গে পড়লো ধরনের বাড়ির একতলায় এই হোটেল। পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি বহুবার, চোখে পড়েনি কখনো।
দক্ষিণ কলকাতার সব কিছুই হয়ত উত্তরের থেকে অনেক বয়েসে ছোটো, নবীন। ব্রিটিশ আমলে আপিস পাড়া বলতে ছিল চৌরঙ্গী আর উত্তরের কলকাতা। তাই অলিতে গলিতে গজিয়ে উঠেছিল ভাতের হোটেল। উত্তরে এখনো আছে আদর্শ হিন্দু হোটেল, জগদ্ধাত্রী আশ্রম, আরো কত কি। কিন্তু পাইস হোটেলের ক্ষেত্রে আমরাও কিন্তু পেছনে পড়ে নেই। আমাদের দক্ষিণী কলকাতার আছে তরুণ নিকেতন। এখনো স্বমহিমায় বর্তমান। কলাপাতা র দাম যেখানে দু টাকা। পাইস মানে যতটুকু খাবে, বাটি পিছু আলাদা আলাদা মূল্য ধার্য করা।
আমি মার্কামারা ভেতো বাঙ্গালী, সেজন্য বিশুদ্ধ বাঙ্গালী রান্নার স্বাদ আমার কাছে অমৃত সম। তার ওপর এই হোটেলগুলোর গায়ে লেগে থাকা ইতিহাসের মন কেমন করা গন্ধ। সবুজ প্লাস্টিক পেইন্ট করা প্রাচীন ইঁটের মোটা দেওয়াল, কড়ি বরগার ছাদ টিনের চালা দিয়ে ঢাকা। শ্বেতপাথরের চৌকো টুকরো দেওয়া কাঠের টেবিল, প্রতি সিটের আলাদা নম্বর। আমি বসেছিলাম ১ নম্বর চেয়ারে। ব্ল্যাকবোর্ডে দূর্বোধ্য হাতের লেখা দিনের মেনু, কলাপাতায় ভাত, নুন, গন্ধ লেবু, লঙ্কা। অচেনা লোকের সঙ্গে গা ঘেঁষে এক টেবিলে খাওয়া, কর্মচারীদের হাসি মুখে নামতার মতন মেনু আওড়ানো, রংচটা হেঁশেলের দরজার ওপর বিবর্ণ কালিতে "প্রবেশ নিষেধ" লেখা। আর খাবার পরে আঁচানোর জন্যে বাইরে উঠোনে একটা কলঘর।
আধুনিক কোলকাতার পাঁচতারা রেস্তোরাঁর হাতছানি ছাড়িয়ে এখানের চৌকাঠ পেরোলেই যেন টাইম মেশিনে চেপে সাদা কালো সিনেমার সেই ফ্রেমে ঢুকে পড়া। সবটুকু মুছে যাবার আগে গেলাম ফিরে কয়েক দশক পিছিয়ে।
হোটেলের বর্তমান মালিক শ্রী অরুণ দেব। তৃতীয় জেনেরশন মালিকানা। তার সাথে দেখা হয়নি, তবে তার নাতি ছিলো আজকের ক্যাশ কাউন্টারে। সপ্রতিভ ছেলেটি বেশ গপ্পি গোছের। বললো দাদুর ঠাকুরদা, শ্রী জগৎচন্দ্র দেব এই হোটেল স্থাপন করেন ১৯১৫ সালে। মানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঠিক এক দশক পরে।
বললো, আজও নাকি এই বয়েসে দাদু নিজে হাতে বেছে রোজ সকালে বাজার করেন। লেক মার্কেটের বাজারে নাকি এক ডাকে সবাই চেনে দাদুকে। বিশেষ করে মাছ বিক্রেতা রা। চিতল, রুই, কাতলা, চিংড়ি, ভেটকি, ট্যাংরা, পাবদা, পারসে, কাঁকরা, ইত্যাদি নিজে হাতে টিপে টিপে বাজিয়ে নেন। তারপর দাদু কেনেন টাটকা মরসুমী সবজি। দাদুকে দরদাম করতে হয়না। রোজকার খদ্দের। তায় আবার হেরিটেজ হোটেল।
এখানে ডিমের ঝোল মানে হাসের ডিম। পোল্ট্রি র ডিম রান্না হয়না। শুনলাম যে মাংস, ডিম আর মাছের কালিয়া ছাড়া অন্য কোনো রান্নায় পেয়াজ রসুন ব্যবহারও হয়না। এটাই এখানের রান্নার নীতি। মনে হয় কাছেই কালীঘাট বলে, তীর্থ যাত্রীদের জন্যেই শুরু হয় এই ব্যবস্থা। এখনো চলছে সেই নিয়ম।
প্রথম দু হাতা ভাত ২০ টাকা। তারপর হাতা পিছু টাকা। ধবধবে সাদা, ধোঁয়া ওঠা ভাত। দুপুরে নাকি ৮-১০ রকমের শুধু মাছের পদ থাকে। আমি খেলাম, পাতলা মুসুর ডাল, আলু পেয়াজকলি ভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, হাসের ডিমের ঝোল, খাসীর মাংস আলু দিয়ে, আর শেষ পাতে আমের চাটনি।
সত্যি বলছি এত তৃপ্তি করে অনেক দিন খাইনি। যেন বাড়ির রান্না। পাতলা হালকা। মার্জিত ঝাল, অশরীরী ঝাঁঝ। পাঁঠার মাংসে নেই কোনো গুঁড়ো লংকার রক্তকরবী। আপিস পাড়ার বাবুদের যেহেতু রোজের খাবার যোগান দিতে হতো, তাই গেরস্থ বাড়ির সাদামাটা রান্নার চলন। কিন্তু স্বাদ অটুট। এ খাবার সপ্তায় ৫ দিন খেলেও অম্বল হবার সম্ভাবনা নেই।
তবে বাড়িটা শিগগিরই ভাঙ্গা পড়বে। নতুন করে গড়া হবে তরুণ নিকেতন। প্রোমোটার কাজে হাত দিয়েছে। এই ধূসর ঐতিহ্য জলদি পাবে চাকচিক্যের মোড়ক। তখন হয়তো আর এই অমোঘ টান বোধ করবো না এখানে এসে পাত পাড়বার। নস্টালজিয়া মনের অসুখের চেয়ে কিছু কম না। আমি আবার সেই রোগে বিপুলভাবে আক্রান্ত।
খেয়ে হাত ধুয়ে বেরোচ্ছি, ছেলেটি দৌড়ে এসে হাতে এক খানা কার্ড গুঁজে দিয়ে বললো, দিদি একদিন দুপুরে আসুন। একটা ফোন করে আসবেন। যা খেতে ইচ্ছে করবে, লইটটা শুঁটকি, চিতল মাছের মুইত্থা, কাকড়ার ঘন্ট, পোস্ত বাটা, কুমড়ো ফুলের বড়া, সজনে ফুল ভাজা, একবার বলবেন।
গুছিয়ে খাওয়াবো।
এমনি এমনি কি আর কোলকাতা ছেড়ে থাকতে পারিনা?

No comments:

Post a Comment